অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাগ থেকে দেখলে বাংলাদেশের
সমাজের ৮০ ভাগ মানুষ গরিব, নিম্নবিত্ত। তাদের অভিজ্ঞতার জগৎ, জীবনবোধ,
মূল্যবোধ উচ্চবিত্ত থেকে অনেকাংশেই আলাদা। আবার উচ্চবিত্তের অংশেও
নিম্নবিত্তের কিছু কিছু মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির দেখা মেলে। চিন্তা ও
তৎপরতার দার্শনিক আন্তনিও গ্রামসির মতে, দুই শ্রেণীর মধ্যকার এই মিল
ও পার্থক্যের ঘটনাটা অর্থনৈতিক শ্রেণী বিভাজনের সরল নিয়ম মেনে চলে
না। তাঁর মতে, এখানে কাজ করে 'আধিপত্য' (hegemony) ও 'দাপট'
(dominance) খাটানোর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া শ্রেণীগুলো সব সময় 'সচেতন'ভাবে
চালায়_এমন না। বরং এটা ঘটে জটিল ও বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ায়। এখানে কাজ
করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিগঠন। অর্থনৈতিক ও
রাজনৈতিক পরিগঠনে আধিপত্যের আওতায় থাকা জনগোষ্ঠীকেই 'নিম্নবর্গ'
(sub-altern) বা 'প্রান্তিক' (marginal) নামে ডাকা হচ্ছে আজকাল। এই
জানা কথা মাথায় রেখেই আজকের বাংলাদেশের নিম্নবর্গ বা প্রান্তিক
জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতির গতি-প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করব।......
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিম্নবর্গের সংস্কৃতি বলে 'চিরকালীন' কোনো কিছু
কি আছে? না, নেই। যেমন নেই জনপ্রিয়, 'সিরিয়াস', 'উচ্চমান' ইত্যাদির
কোনো চিরায়ত চেহারা। কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা দিয়ে নিম্নবর্গের
সংস্কৃতিকে চেনা যায়; যেমন_তার পরিবেশনার বিষয় ও ভঙ্গি, জগৎ দেখার
ভঙ্গি ইত্যাদি। নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গের সাংস্কৃতিক লেনদেন হয় এবং তা হয়
একটা লড়াই-মিত্রতার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে। পুঁজিতন্ত্র ও পশ্চিমা
সেক্যুলার আধুনিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রব্যবস্থা বাংলাদেশের
নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক জগৎকেও নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের নিম্নবর্গ
তার সংস্কৃতির সনাতনি উৎপাদক ভূমিকায় আর নেই। শিক্ষাব্যবস্থা,
গণমাধ্যম এবং উৎপাদন সম্পর্কের বিন্যাসের মাধ্যমে নিম্নবর্গ
উচ্চবর্গের সাংস্কৃতিক প্রকল্পের অধীনে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এই
প্রকল্পের অধীনে থাকা, এর থেকে বের হওয়ার লড়াই_এসবের অভিজ্ঞতা
নিম্নবর্গের নতুন সাংস্কৃতিক প্রকাশের সম্ভাবনা জাগায়। এটা একটা
দীর্ঘ সময়ের, অব্যাহত প্রক্রিয়ার ব্যাপার।.......
গত চার দশকে বাংলাদেশে সমাজ-অর্থনীতির যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা
নিম্নবর্গের তথা জনসংস্কৃতির প্রগতিশীল বিকাশের অনুকূল নয়।
স্বাধীন-জাতীয় পুঁজির বিকাশ না হওয়ায়, করপোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণ
দুর্নিবার হওয়ায়, সমাজ-অর্থনীতির গণতান্ত্রিক রূপান্তর না হওয়ায় তা
আমাদের নিম্নবর্গের সম্ভাবনাময়, প্রগতিশীল ধারার বিকাশে সহায়ক হচ্ছে
না। বাংলাদেশের নিম্নবর্গীয় জনসংস্কৃতির ধারা স্বমহিমায় বিকশিত হবে
কি হবে না, তা উচ্চবর্গের দয়া-দাক্ষিণ্য-উদারতার ওপর নির্ভর করছে না;
নির্ভর করছে সমাজ ও রাষ্ট্রে নিম্নবর্গ জনগোষ্ঠী তাদের ক্ষেত্রবিশেষে
রক্ষণাত্মক, ক্ষেত্রবিশেষে প্রান্তিকতার দৃষ্টিভঙ্গিজাত সংস্কৃতির
পুনর্বিচার, বিনির্মাণ ও তার সাপেক্ষে নিজস্ব কর্তাসত্তার বিকাশ ঘটাতে
সচেষ্ট কি না, সমাজের গণতান্ত্রিক অংশ তার সঙ্গে নিজের বিকাশের
স্বার্থেই মৈত্রী গড়ে তুলছে কি না তার ওপর। কর্তাসত্তার বিকাশের এই
প্রক্রিয়ায় 'নিম্নবর্গীয়', 'জনপ্রিয়', 'সিরিয়াস', 'উচ্চমান'_সব ধরনের
সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বিন্যাস ঘটতে থাকবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগীতশিল্পী
|